অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো..

  • Posted By : Muhammad Mizanur Rahman
  • 213 views


সম্পদের অহংকার থাকা মানুষদের প্রতি সত্যিই বড় করুণা হয়, তাদের আকল ও বিবেকের নাজুকতায় আফসোস লাগে, যখনই অন্তরে দুনিয়া লালনকারী দাম্ভিক কোন সম্পদশালীকে দেখি ছেলেবেলার স্মৃতি বিজড়িত কিছু দৃশ্য কল্পনায় ভাসে। 

পদ্মা নদীর পাশে কুষ্টিয়ার একটা গ্রামে একটি সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলাম, যতটুকু মনে পরে ৬/৭ টি ঘর বিশিষ্ট বিশাল বাড়ির আশে পাশে ছিল কয়েক বিঘা চাষাবাদের জমি। 

বাড়ির সামনে ছিল ২০/২৫ টি কাঠাল গাছের বাগান, তার পাশে ছিল বিশাল এক পুকুর যার তীরে আতাফল গাছ, আমড়া গাছ ও বেশ কিছু ফল গাছের সমাহার। 

বাড়ির চারপাশে ছিল বেশ কয়েকটা বড়ই গাছ ও নারিকেল গাছের ভান্ডার, আর বাড়ির পিছনে ছিল এক পুকুর যা পেড়িয়ে যেতে হত আমাদের আম বাগানে যেখানে ৪০/৫০ টা আম গাছ ছিল। এখনো মনে আছে দূরবর্তি সিমানা দেখিয়ে দাদা বলত এখান থেকে যতদূর চোখ যায় সবগুলোই আমাদের জমি। খুব কমই শস্যই ছিল যা আমরা উৎপাদন করতাম না, ধান, গম, ভাঙ্গি, আখ, পিয়াজ, এবং বিভিন্ন শাক সবজি ও ফলের বাগান ছিল। 

আল্লাহর দেওয়া রিজিকের ব্যাপারে কখনো চিন্তিত হতে হয় নি, প্রায় প্রতিবছরই পদ্মানদীর ওপারে বিপুল পরিমান শাক সবজি ও ফলমূল রপ্তানি করতাম। 

ছোটবেলায় দেখা রাজত্বকে চোখের সামনে যেদিন নদীতে পরে যেতে দেখি পদ্মানদী ভাঙা শুরু করায়, অবাক হয়ে চেয়েছিলাম এটা ভেবে যে আর কখনো আমবাগানে খেলা হবে না, হবে না দাদাকে ফাকি দিয়ে ক্ষেত থেকে বিভিন্ন শস্য নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে খাওয়া। 

যখন সকল গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছিল, বিক্রি করা হচ্ছিল শেষ বারের মত সকল ফলমূল, চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নি সেদিন, ভাবছিলাম নদী কি তাহলে আমাদের সকল কিছু নিয়ে যাবে? 

কিন্তু এমনটা যে হওয়ারই ছিল, নদী যে কারো কান্না শুনে না , শুনে না কারো আত্মচিৎকার, কয়েকদিনের প্রহর ফুরিয়ে গেলে সবকিছু ভেঙে ফেলল, কোন অস্তিত্ব আর বাকি থাকল না, শুধুমাত্র ঘরগুলোর চালাগুলো স্থানান্তর করা হয়েছিল, এছাড়া যত জমি জমা, গাছ গাছালি ছিল সবই চলে গিয়েছিল নদীর ভূগর্ভে। 

বাড়ি ছাড়ার কয়েকদিন আগ পর্যন্ত রাতে তেমন ঘুমাতে পারি নি কেননা নদী এতই কাছেই ছিল যে  ভাবতাম এই বুঝি আমরাও নদীর মাঝে পড়ে যাব। পানিতে মাটির পাড় পরার শব্দ শুনতে শুনতে চলে যাওয়ার প্রহর গুনতাম৷ সেদিন নদী শুধু আমাদের জায়গা সম্পদি বা ঘরই ভাঙেনি, ভেঙেছিল আমাদের স্বপ্ন, আমাদের একটু ভালো থাকার সম্ভবনা, ঝরিয়েছিল হাজারো মানুষের চোখের পানি। আজও ছেলেবেলার কান্না বিজড়িত স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখের সামনে, নিজের অজান্তেই একটা ক্ষোভ সৃষ্টি হয় নদীর উপর। 

আম্মু, আব্বু নাকি তিন বার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছিল, যেখানে আমি দুইবার দেখেছিলাম স্বচক্ষে। 

সেখান থেকে ঘর বাড়ি নিয়ে পারি জমিয়েছিলাম আরেক ঠিকানায়, নদী থেকে বেশ কিছুটা দূরে তবে সেই গ্রামেই, সেখানেও গড়েছিলাম নতুন করে সম্রাজ্য। 

ভেবেছিলাম নদী হয়ত আর কখনো আমাদের নাগাল পাবে না, তাই আবার নতুন করে স্বপ্নবুনতে লেগেছিলাম, এক নদী ভাঙনে প্রাচুর্যের পরিমান শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল, তবে দাদার জমিজমা বেশি থাকায় নতুন করে উঠে দাড়াতে বেশি সময় লাগে নি, আবার গড়েছিলাম সম্রাজ্য, আমার আর আন্টির এক বিঘা জমির ওপর ছিল শখের বাগান, বাড়ির চারপাশে ছিল ফুল বাগানে সাজানো, আবার চাষাবাদ, ও দোকান দিয়ে শুরু হয়েছিল পথচলা, ভালোই চলতে ছিল কিন্তু সেখানেও বেশিদিন ঠাই হয়নি, নদীর কালো থাপা ঠিকই কেড়ে নেয় কয়েক বছরের পরিশ্রমের গড়া রাজ্য। 

ততদিনে বুঝতে শিখে গিয়েছিলাম, জীবনের উত্থান পতন, ছোট দুই ভাই তখনো বেশ ছোট, তারা হয়ত বুঝতেই পারে নি জীবন তাদের কি উপহার দিয়েছে।  

তৃতীয় বারের মত যেখানে ঠাই হয়, সেখানেও আবার নতুন করে শুরু করার প্র‍য়াস ছিল, কিন্তু ততদিনে গ্রামের সবাই বাস্তবতা বুঝে গিয়েছিল, তাই অনেকেই গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমায়, তাদের মধ্যে আমাদের পরিবারও শহরে পাড়ি জমায়৷ 

তখন থেকে এই পর্যন্ত সময়টা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না, তারপরও এগিয়ে যাওয়ার প্র‍য়াস ছিল অফুরন্ত কেননা স্বচক্ষে দেখেছিলাম অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যের দাম্ভিকতা কিভাবে ধবংশ হয়। ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম দুনিয়ার জীবনে জায়গা সম্পদ চিরস্থায়ী হয় না বরং তার মূল্য খুবই তুচ্ছ ও সাময়িক। 

বর্তমানে গ্রামে অনেক জায়গা পরে আছে, আরো তো আছেই দুই জায়গায় নদীর ভুগর্ভে, শুনেছি সেখানে নাকি চর হওয়া শুরু করেছে। কিন্তু এখন আর পরিবারের কাউকে সেই জমিগুলো নিয়ে চিন্তিত হতে দেখি না, তারাও হয়ত দুনিয়ার বাস্তবতায় এটা বুঝতে পেরেছে এই সম্পদের মূল্য কতটা ক্ষনিকের, হয়ত এখনো বুঝে নি, জানি না, তবে আমি ঠিকই বুঝেছি জীবনের জন্য মূল্যবান হল যোগ্যতা, ইলম, নৈতিকতা, আদর্শ। তাই প্রায় সব ভাইকেই যোগ্যতা অর্জনের পরামর্শই দিয়ে থাকি। 

তবে যোগ্যতা অর্জনের এই যাত্রায় লক্ষ্যটা এবার সেই সম্পদ ও প্রাচুর্য অর্জনের জন্য নয়, বরং এমন কিছু করা যা কখনো ধ্বংশ হয় না, যাকে নদী কখনো ক্ষতি করতে পারে না, মানুষ কখনো ধসিয়ে দিতে পারে না, যার জন্য হিংসা বিদ্বেষ তৈরি হয় না। যার দ্বারা হয়ত বিখ্যাত হওয়া যাবে না কিন্তু মানুষের অন্তর থেকে দোয়া ও ভালোবাসা পাওয়া যাবে, সমাজে ইট পাথরের দালানটা যেমনই হোক, মনটা যেন হয় আকাশ সমান বিশাল। 

বিগত বছরগুলো থেকে শিখা হয়েছে অনেক কিছু, দেখা হয়েছে মানুষের হাজার রকমের রূপ, তবে একটা বিষয় সবচেয়ে বেশি বুঝেছি, এ শহরের মানুষ অর্থ সম্পদের পূজারী,  তাদের জীবন আবর্তিত হয় গুটিকয়েক কাগজের নোট ও মান-খ্যাতি অর্জনকে কেন্দ্র করে৷ এ শহরের বাবা মায়েরা সন্তানকে আর সন্তান হিসেবে ভালোবাসে না বরং তাদের দ্বারা অর্থ সম্পদ গড়াকেই জীবনের লক্ষ্য ভাবে, মানুষের মানসিকতা এখন পুজিবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়। 

সন্তানেরা আর মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত দেখে না, বরং তাদের বৃদ্ধ বয়সে তাদের আবাসন ব্যবস্থাকে বোঝা মনে করে, শিক্ষক আর মানুষ তৈরির জন্য পড়ায় না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর শিক্ষিত মহামানব তৈরি করে না, বরং সকলেই পুজির পিছনে ছোটে, তাই তো ডাক্তারের সেব মূলক পেশাও এখন ব্যবসায়িক রূপ নিয়েছে৷ সকলেই যেন পুজিপতি হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তাদের কাছে এখন অর্থ সম্পদই মুখ্য৷ 

তাই তো এদেশে আর কোন উদ্ভাবক তৈরি হয় না, হয় না ভালো মানে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার, মানুষগুলোও দিন দিন পশু হয়ে যাচ্ছে, স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি থেকে নৈতিকতা সম্পন্ন উন্নত শিক্ষার্থী বের হচ্ছে না বরং মাস শেষে কাগজের নোট পাওয়ার লোভি কয়েকজন ইদুর দৌড়ের দাস বের হচ্ছে৷ 

এখন আর কেউ তাকওয়া খুজে না, খুজে না সততা, কিংবা আদর্শবান ব্যক্তিত্ব, কেউ আর নীতি নৈতিকতা ও ন্যায় বিচারের ধার ধারে না, সকলেরই নাকি পুজিপতি হতে হবে, গড়তে হবে সম্পদের পাহাড়, তাই তারা এতটাই অন্ধ হয়েছে আল্লাহর ভয়, কবরের আজাব, পরকালের বাস্তবতা মানুষকে আর ফজরের সালাতে জাগ্রত করতে পারে না, বরং সেই ঘুটি কয়েক কাগজের নোটের লোভ ঠিকই ৮/৯ টার ইদুর দৌড়ে অংশগ্রহণ করাচ্ছে। 

জীবনের এই পর্যায়ে এসে একটা শিক্ষা নিয়েছি, দুনিয়াতে কোন মানুষের সাথে সম্পর্ক করার মুখাপেক্ষী হব না কখনো, দুনিয়া লোভি মানুষের সাথে সম্পর্ক করা, কথা বলা, কাজ করাকে নিজের জন্য অপমান মনে করব। একাকিত্বকে নিজের সঙ্গি বানিয়ে নিব, সমাজে খুটি কয়েক খাটি মানুষের সাথে পরিচয় রাখব, যত পারি মানুষের পাশে দাড়াবো, অন্যের উপকারে মাধ্যমে নিজের জীবনটাকে কাজে লাগাব। বাচব একমাত্র আল্লাহর জন্য, এই আশাই রাখব মৃত্যুও যেন হয় একমাত্র আল্লাহর জন্য। ইং শা আল্লাহ।


Leave Your Comment